চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসিন্দা প্রায় ৬০ লাখ। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা মেটায় চট্টগ্রাম ওয়াসা। পানি বিক্রিই প্রতিষ্ঠানটির আয়ের একমাত্র উৎস। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির কাছে ওয়াসার বিল বকেয়া প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান বিল পরিশোধ করে না প্রায় ১০ বছর। চিঠি দিয়েও বিল আদায়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
বকেয়ার তালিকায় রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (পিডিবি)। ওয়াসার পর্যালোচনা বলছে, ব্যক্তি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিলের ৯৭ শতাংশ আদায় হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিগত বছরে আদায়ের হার মাত্র ৩৯ শতাংশ। তবে বকেয়া রাখা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, চাহিত পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে ওয়াসার বকেয়া পরিশোধ সম্ভব হয় না। চট্টগ্রাম ওয়াসার রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১০ বছর ধরে সরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ওয়াসার পানির বিল বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে সরকারি আট শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া প্রায় ১৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক ও রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কিংবা গ্রাহক থেকে বকেয়া আদায় সহজ হলেও সরকারি সংস্থাগুলো থেকে বকেয়া আদায় করা অনেক কঠিন।
রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানায়, পানি বিক্রিতে বর্তমানে ওয়াসার বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। এক লাখ টাকার ওপরে বকেয়া রয়েছে এমন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংযোগ রয়েছে তিন হাজার ২১২টি। এর মধ্যে বেসরকারি সংযোগ দুই হাজার ৯২৫টি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংযোগ ২৮৭টি। প্রতি বছরই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়ছে বকেয়ার পরিমাণ। বছরের পর ধরে বকেয়ার পরিমাণ বাড়লেও অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার অজুহাতে পুরোপুরি পরিশোধের পদক্ষেপ নেই সরকারি দপ্তরগুলোর।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বকেয়া বিলের শীর্ষ রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতাধীন ডিভিশনগুলোর বিভিন্ন স্থাপনায় ৫০টি সংযোগের বিপরীতে বকেয়া ৮ কোটি ৬৫ লাখ ৬১ হাজার ১৩৭ টাকা।
এ বিষয়ে কথা হলে গণপূর্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল কাশেম মোহাম্মদ শাহজালাল মজুমদার বলেন, সত্যিকার অর্থে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি বলেই চট্টগ্রাম ওয়াসার বিলগুলো বকেয়া রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও এসব বকেয়া পরিশোধের অর্থ বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তদবির করেছি। আশা করছি বরাদ্দ প্রাপ্তি সাপেক্ষে দ্রুততম সময়ে ওয়াসার বকেয়া বিলগুলো পরিশোধ করা হবে।
ওয়াসার বকেয়া পাওনার তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিল রয়েছে চসিকের কাছে। ৯২টি সংযোগের বিপরীতে নাগরিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটিতে ওয়াসার বকেয়া পড়েছে তিন কোটি ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭০ টাকা। তবে ওয়াসার সঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট লেনদেন রয়েছে বলে জানিয়েছেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা সিটি করপোরেশনের বড় স্টেকহোল্ডার। পানির বকেয়া বিলের বিষয়ে ওয়াসা থেকে একটি চিঠি পেয়েছি। মূলত ওয়াসার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের অন্য খাতেও আর্থিক লেনদেন রয়েছে। বিশেষ করে নগরীর সড়কগুলো বানায় সিটি করপোরেশন, কিন্তু কাটে ওয়াসা। ওয়াসা সড়ক কাটলেও নাগরিকের গালি শুনতে হয় সিটি করপোরেশনকে। সড়ক কাটা নিয়ে ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে আরও বেশি টাকা সিটি করপোরেশন পায়। তারপরেও ওয়াসার পানির বকেয়া বিল পরিশোধের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির বকেয়া বিলের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে সিএমপি। সিএমপির বিভিন্ন স্থাপনায় ওয়াসার ৩১টি সংযোগের বিপরীতে বিল বকেয়া পড়েছে দুই কোটি ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ৬৩৫ টাকা।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রতিষ্ঠানটিতে ১৪টি সংযোগের বিপরীতে ওয়াসার পাওনা এক কোটি ৯ লাখ ৮২ হাজার ১৩৮ টাকা। চট্টগ্রামে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে ২৪ সংযোগের বিপরীতে বকেয়া এক কোটি ৮ লাখ ৩৪ হাজার ১৬০ টাকা। একইভাবে পিডিবির কাছে ৩৬টি সংযোগের বিপরীতে ৫৮ লাখ ১০ হাজার ৪৪৩ টাকা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১টি সংযোগের বিপরীতে ৪৮ লাখ ১৮ হাজার ৮৬৫ টাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ১৫টি সংযোগের বিপরীতে বকেয়া জমেছে ৪২ লাখ ৮১ হাজার ৬৭৮ টাকা।
ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার তাগাদা দিয়েও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বকেয়া বিল পরিশোধ করছে না। এর মধ্যে জরুরি সেবার আওতায় থাকা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ) মো. লাল হোসেন বলেন, বকেয়া আদায়ে চট্টগ্রাম ওয়াসা সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি বকেয়া আদায়ের বিষয়ে জুন মাসের দিকে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিমান্ড দিই। বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে তারা আমাদের বিল পরিশোধ করেন। এখানে যে বকেয়া রয়েছে, সেগুলো পরিশোধের বিষয়ে নিয়মিত চিঠি দিচ্ছি। তিনি বলেন, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের শুরুতে চট্টগ্রাম ওয়াসার মাসিক বিল ছিল ১৪ থেকে ১৫ কোটি টাকা। এখন সেই বিল মাসে ২৩-২৪ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। মূলত ওয়াসার কার্যকর উদ্যোগের ফলে মাসিক বিলিং বেড়েছে, আনুপাতিক হারে আদায়ও হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মকর্তা বলেন, বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য ওয়াসা থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত চিঠি দেওয়া হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান চিঠির জবাবও দেন না। আবার কিছু জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাইলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম ওয়াসার বড় আয়ের উৎস পানি বিক্রি। সবশেষ ডিসেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিল হয় এমন সংযোগ রয়েছে ৯০ হাজার ৭২৩টি। ডিসেম্বর মাসে গ্রাহকদের কাছে বিল হয়েছে ২০ কোটি ১ লাখ ৪ হাজার ৩৩৮ টাকা। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে বিল হয়েছে ১১৯ কোটি ৮১ লাখ ৬৩ হাজার ১৪৬ টাকা। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে ব্যক্তিখাতে বিল হয়েছে ১৭ কোটি ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯৫১ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিল হয়েছে দুই কোটি ৩২ লাখ ১৯ হাজার ৩৮৭ টাকা।
ডিসেম্বর মাসে বিল আদায় হয়েছে ১৭ কোটি ৮৩ লাখ ৮২ হাজার ৭২৬ টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আদায় হয়েছে এক কোটি ১৯ লাখ ১৫ হাজার ৯৪১ টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট বিলের ৪৩ শতাংশ আদায় হয়েছে। বিগত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৩৯ শতাংশ। যেখানে ব্যক্তিখাতে আদায়ের হার ৯৭ শতাংশ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

সিংহভাগ বিলই সরকারের কাছে
চট্টগ্রাম ওয়াসায় বকেয়া ১৬০ কোটি টাকা
- আপলোড সময় : ১৭-০৩-২০২৫ ১০:২৪:০০ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৭-০৩-২০২৫ ১১:৪৫:৫৪ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ